ভয়
ভয় করে…
খালাম্মা, তোমার গন্ধে ঘুম আসে না যে!
এখন ওপাশ ফেরো, অন্যদিকে মুখ করে শোও।
তোমার ভিতরে কী যে হাওয়া কী যে জ্যোৎস্না কী যে নোনা বাদাড়ের ঘ্রাণ!
ভূতের পায়ের মতো শোঁ শোঁ শব্দে বড়-বড় পাতা ঝরে,
তোমার চোখের মধ্যে লণ্ঠনের শিখা নাচে কেন?
তুমি কি খেলার মাঠ? চিলেকোঠা? খোসাহীন বাদামের ছড়াছড়ি?
উদামবুদাম শরীরে তোমার কী যে তাপ! কী যে জ্বর!
আমাকে এমন করে কেন তুমি জাপটে ধরেছ?
আমি কি শিমুল ফুল? লেপের ভিতর শীত? দলামচা বালিশ?
খালাম্মা, তোমার বুকে সরিষা ফুলের গন্ধ! চড়ুইয়ের পাখার ভিতরকার ওম!
তোমার নাকের কেশরের তাপে আমি পুড়ে যাব… পুড়ে যাব…
আমি পুড়ে ছাই হয়ে গেলে তুমি কি ফুঁ দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দেবে সেই ছাই?
খালাম্মা, আমার ভারী ভয় করে, আমাকে নামিয়ে রাখো পাশে-
মা দেখলে বকবে না?
খালাম্মা, তোমার গন্ধে ঘুম আসে না যে!
এখন ওপাশ ফেরো, অন্যদিকে মুখ করে শোও।
তোমার ভিতরে কী যে হাওয়া কী যে জ্যোৎস্না কী যে নোনা বাদাড়ের ঘ্রাণ!
ভূতের পায়ের মতো শোঁ শোঁ শব্দে বড়-বড় পাতা ঝরে,
তোমার চোখের মধ্যে লণ্ঠনের শিখা নাচে কেন?
তুমি কি খেলার মাঠ? চিলেকোঠা? খোসাহীন বাদামের ছড়াছড়ি?
উদামবুদাম শরীরে তোমার কী যে তাপ! কী যে জ্বর!
আমাকে এমন করে কেন তুমি জাপটে ধরেছ?
আমি কি শিমুল ফুল? লেপের ভিতর শীত? দলামচা বালিশ?
খালাম্মা, তোমার বুকে সরিষা ফুলের গন্ধ! চড়ুইয়ের পাখার ভিতরকার ওম!
তোমার নাকের কেশরের তাপে আমি পুড়ে যাব… পুড়ে যাব…
আমি পুড়ে ছাই হয়ে গেলে তুমি কি ফুঁ দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দেবে সেই ছাই?
খালাম্মা, আমার ভারী ভয় করে, আমাকে নামিয়ে রাখো পাশে-
মা দেখলে বকবে না?
চুমু
চুমুর টিলায় দাঁড়িয়েছিলাম
মনে আছে, মনে?
দুলল আকাশ দুলল পাতাল
পায়ের নিচের পৃথিবী মাতাল
মনে আছে, মনে?
কেবল আমরা টলিনি দুইজনে।
অভিজ্ঞতা
নৌকাভ্রমণে গিয়ে অভিজ্ঞতা হলো,
একবার দুজন খুব জলের কাছে সরে
এসে
নুয়ে তাকিয়েছিলাম নিচে
যেখানে থির জলে ফুটেছিল আমাদের নৌকার গলুই
আর
কান্তিমান চলন্ত চোখে–চোখে তাকিয়ে
মনে হয়েছিল আমার
নৌকার গলুইটা যেন জলের নিচের গলুইটাকে
চুমু খাবে বলে ভেসে গেল সারা দিন ধরে –
কিন্তু সারা জীবনে কোনোদিন চুমু খাওয়া হবে না তার
আমি বুঝেছিলাম, তুমিও বুঝেছিলে
তবু তো সেই নৌকাযাত্রার দুপুরে
আমরা আমাদের জীবনের দীর্ঘতম চুমুটি খেয়েছিলাম, মনে আছে?
ভ্রমণকাহিনী
৪.
আমি ছুঁয়েছিলাম তার স্তন
এমন মর্মরিত নৈঃশব্দ আমি জীবনে ছুঁইনি
আমি ছুঁয়েছিলাম তার আঙুলগুচ্ছের অন্ধকার
এমন অসাধারণ ব্যর্থতার পাশে আর আমি কোনোদিন দাঁড়াইনি
আমি নাক ডুবিয়ে দিয়েছিলাম তার চুলে
এমন পল্লবিত গাছের ঘ্রাণ আমি আর কখনো পাইনি
আমি মুখ গুঁজে দিয়েছিলাম তার কাঁধে
এমনভাবে আর আমি ভেঙে পড়িনি কোনোদিন
আমি চুমু খেয়েছিলাম তার ঠোঁটে
এমন দীর্ঘ নৈঃসঙ্গের কবলে আমি আর কোনোদিন পড়িনি
কোনো মহিলার জন্য এগারোটি প্রেমের কবিতা
৬.
এস, চুটিয়ে বৃষ্টির মতো কথা বলি
এস, আকাশের মতো চুপচাপ বসে কথা বলি
ঠান্ডা হয় কাপের চা, পত্রিকার পাতাটি ওল্টাল
পরমাণুযুদ্ধের আতঙ্ক ঐ তো নিমেষে জুড়াল
কাঁপিয়ে চশমার কাঁচ আমি হেসে ওঠি, তুমিও হাসো
রানু, দেখ–দেখ, ঐ যে ছবিতে দুজন বুড়োবুড়ি…
সুন্দর যে হলুদ ঘাসও।
উড়ে যাবে তর্কে বহুদূর
“দেখ, দেখ কী সুন্দর মাছি! ”
বলতে–বলতে তুমি হেলে
বসলে এমনভাবে যেন
তোমার কলেজে পড়া মেয়ে
তুমি – আর বললেও এমন
ভাবে যেন আর কেউ শুনে
ফেলে ঠিক–ঠিক বলে দেবে–
“বাঃ ভারি তো স্বচ্ছ দুটি মাছি!“
অথচ কতটা কাছাকাছি
আছ তুমি আমার এবং
ভেবে দেখ এক টেবিলের
এই যে দূরত্ব–স্রোতহীন
কোনো কথা ছাড়া একা–একা
ভোঁ–দৌড়ে পেরিয়ে যেতে পারি
আমিও–যখন তুমি এই
ডিসেম্বরেই পেরুলে চল্লিশ
আর আমি ক্লান্ত বায়ান্নতে
অপেক্ষায় জেগে বসে আছি
কখন আসবে থার্ড স্ট্রোক।
তবু এই ভোরবেলা, এই
আজকেরই ভোরের বেলায়
তোমার আমার অসমাপ্ত
চায়ের কাপের দেশে কেন
উড়ে এল এই অতি স্বচ্ছ
অতি নীল ডানাঅলা মাছি?
“ওমা, দেখ, একটি কোথায়
উড়ে এল আরো একটি যে “–
কেমন অবাক লাগে – নাকি
তোমার কষ্টের লতা দুলে
উঠে হালকা কৌতুকে, তাকিয়ে
দেখি সত্যি–সত্যি আরেকটি
সত্যিকার মাছি উড়ে এসে
বসেছে তোমার পিরিচের
কিনারে–ফুরফুরে ডানাঅলা–
তবে তর্ক যদি না-ই করি
বলব আমি দ্বিতীয় মাছিটি
আরো বেশি নীল। খুব নীল।
নেহাতই দুটিতে মিলঝিল
খুঁজতে যাওয়াটাই বাতুলতা –
পৃথিবীর এক ভোরবেলা –
যখন অনেক ভোর ফেটে
চৌচির হয়েছে – ফেটে – ছেটে
টুকরো-টুকরো হয়ে গেছে
পৃথিবীতে যখন আবারো
নতুন সিগারেটের মতো
রাংতা ছিঁড়ে বের হয়ে আসে
ভোর-সাদা-শুভ্র-কান্তিমান
ভোর-এবং আমরা যখন
নক্ষত্রযুদ্ধের বিস্ময়ের
দিক থেকে সাধারণ দুটি
মাছির ডানার নীলিমার
বিস্ময়ে মজেছি: তুমি জানো
জীবন সহজ ততটাই
যতটা পেরিয়ে আসা যায়
চোখ বুজে – আবার চোখ না
বুজে-
তবু একটি নীল মাছি ছিল
এখন আবার দুটি হলো
হয়তো তৃতীয় মাছিটিও
নীল হয়ে আছে আরো বেশি-
কোথাও না কোথাও আছে, দেখ
খুঁজে –
এমনকি উড়েও আসতে পারে
এখানে, চাই কী এখানেই –
আমাদের এই দায়সারা
ভোরের কথোপকথনের
কিছু কানাকড়ি শুনতেও
পারে আড়ি পেতে; পারে নাকি?
না পারুক-
আমরা তো দুজনেই জানি
আজকের ভোরবেলা ঠিক
আজকেরই ভোরবেলা, আর
আজকের তুমিও আগের
তুমি নও – আজকেরই তুমি
এবং তুমি কখনোই দুজন
নও বলে ঘাড় কাত করে
দেখে নিলে সকাল-সকাল
হকার ছেলেটা দিয়ে গেল
আজকের খবর কাগজ
এবং আমিও এতক্ষণে
যেন খুব জরুরি একটা
কাজ পাওয়া গেল – দৃশ্য পাওয়া
গেল – যা নিয়ে একটু নড়ে –
চড়ে বসা যায় –
এইভাবে
তোমার বারান্দা-জুড়ে-পড়া
রোদ দেখি পত্রিকার পাশে-
দেখি রোদ ও পত্রিকা, দুই-ই
বারান্দায় বাসি হয়ে যায়,
আমরা দুজন কেউ গিয়ে
ছুঁয়েও দেখি না। মনে হয়
পৃথিবীতে সংবাদপত্রের
সভ্যতার যুগ বুঝে শেষ
হয়ে এল –
তবুও আমরা জানি নাকি
হৃদয় এবং মানুষের
জনগণ আর সরকারি
উন্নতির খবর অশেষ –
বিজ্ঞান, নক্ষত্র, রাষ্ট্রযন্ত্র,
পরাশক্তি, নভযানখেয়া
নড়েচড়ে পাতা উল্টে চোখে
ঘেঁটে দেখি শেষের পৃষ্টার
অষ্টম কলামে পৌঁছে গিয়ে
তবু দেখি
মানুষই মূলত খবর
মাছিদের ডানা বা সূর্যের
খবরাখবর মাঝে-মাঝে
দেশে-দেশে রক্তাক্ত উত্থান
এবং জান্তাদেরই জয়ে তবু
নগরীতে আলোকসজ্জার
জয়োল্লাসে-
ভিতরের পাতায় নেহাত
কখনো-কখনো হৃদয়ের
সংস্কারের সংবাদ আজো
সংবাদ মূল্য দাবি করে-
এবং কুকুর, ভেড়া, পাখি,
ছাগল, মানুষ নির্বিশেষে
সবার দাবির প্রতি ক্লান্ত
সমর্থন জানিয়ে-জানিয়ে
ব্যর্থ – তবু আর্থ-সামাজিক
পুনর্বিন্যাসের পাশে দেখি
‘আলাদা হাসপাতাল চাই’
শিরোনামে কোনো একদল
গ্রামবাসী চিঠি লিখে ফেলে
সহৃদয় কর্তৃপক্ষ আর
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের
করুণা প্রার্থনা করে গেছে।
দেখে শুনে মনে হয় আজ
বাংলাদেশে বুঝি কোনো
প্রত্যন্ত অঞ্চল বলে এক-
ফোঁটা নির্জনতা বাকি নেই
কোনোখানে-
তুমি বোঝো- আমিও তো বুঝি
তার মানে –
বুঝি রিলিফ সর্বত্রগামী
এমনকি হৃদয় অবধি
চলে গেছে বিকেন্দ্রীকরণ।
বলো তো তবু কেন আজো
হৃদয়ে-হৃদয়ে গড়ে উঠল না
পাকারাস্তা-প্রধান সড়ক?
এও কি তথ্য-সাম্রাজ্যবাদের
তথ্য চালাচালি? দেখে আজ
পিঁপড়ে ও পোকারা সমিতির
ছত্রছায়া খূঁজে ফেরে-তাই
পঁয়ষট্টি হাজার গ্রামের
নিরন্ন মিছিল নিয়ে আজ
বাংলাদেশ একটি নির্বাক
গ্রাম। হৃদয়ের মতো চুপ –
প্রচন্ড নিশ্চুপ –
নৈরাজ্যে নিখিল হানাহানি
পড়ে বসে মুদ্রণ নির্ভর
সভ্যতার টাউট-সন্তান
সংবাদপত্রের পৃষ্টায়।
রমরমা ব্যবসা বেড়ে যায়
পাইকারি সংবাদ বিক্রেতা
এবং খুচরো যারা ক্রেতা
তাদের চাহিদা অনুযায়ী
আমরাও কিনে আনি নিত্য
নতুন প্রযুক্তি; বিপ্লবের-
নিউক্লিয়ার ভালবাসার,
মানব ও মানবীর কাছে
আল্ট্রাথিন সম্পর্কের আর
আগামী সন্তানসন্ততির-
অথচ ‘নিজস্ব সংবাদ
দাতা’ নেই হৃদয়ের – আছে
তবু এক্সক্লুসিভ খবর
অনেক পতিতালয় থেকে
শুরু করে বাস্তু উচ্ছেদের
কাহিনী সংবাদ – আরো কত
সচিত্র মৃত্যুর সংবাদ –
অদ্ভুত সংবাদ-ক্ষুধা আজ
মানুষের – কিছুতে মেটে না;
দাও আরো সুন্দর ভাষায়,
নিখুঁত মনোজ্ঞ বর্ণনায়,
দাও হে চমৎকার গাঢ়
ঠসঠসে আতঙ্ক মাখিয়ে-
আতপচালের সাথে দাও
হলুদ আটার সাথে দাও
রেশনের কার্ড প্রতি দাও
তেল, চিনি. পিয়াজ, রসুন
সোয়াবিন, ডালডায়, সাবানে,
কাঁকড়ে মাখিয়ে দাও – দেখ
তবুও মিটবে না এই ক্ষুধা –
মনে হলো নীরবতা যেন
বলছে হঠাৎ মুখ তুলে
মায়েদের মতো মাথা নেড়ে:
“সংবাদ চাও না তুমি আর?
কোনোই সংবাদ? গুম খুন,
রাহাজানি, ধর্ষণ, শান্তির
জন্যে জনপ্রিয় খুনিদের
সর্বশেষ গুপ্ত-বৈঠকের,
হাসিনার, খালেদা জিয়ার,
এরশাদের, ম্যারডোনার,
রিগ্যানের, গরবাচেভের,
সাম্প্রতিক গদ্যের পদ্যের”?
না, না, না, হঠাৎ দেখি দূরে
উত্তরের শীতের হাওয়ায়
বরফযুগের পৃথিবীর
মতো মাথা তুলে খবরের
পত্রিকাটি আর্ত চিৎকারে
বলতে চাইছে আমাদের;
এ বিশ্ব তবু কি কোনোদিন
মানুষের বসবাসযোগ্য
হবে না? সিরাজ মাষ্টারের
ছেলের লাশের খোঁজ তবে
নিয়ে আসবে কি সিরাজ
মাষ্টারেরই পচা-গলা-লাশ?
পুলিশের হেফাজত থেকে
মুনিরুদ্দির কিশোরী কন্যা
ফিরে আসবে কি তবে স্বাধীন বাংলার
ভয়ার্ত পতাকা হয়ে আজো
বারবার?
কেউ এলে তবু এক সের
ছোট আলুর যোগাড় হয়,
তাই আজ সায়েমুদ্দিনেরা
প্রতিদিন গণভোট চায়
প্রতিদিন দলাদলি চায়
পোস্টার, ফেস্টুন চায়, জন-
নেতাদের কাছে গিয়ে, ডাক-
সাইটে আমলাদের কাছে
গিয়ে রেখে আসে ফরিয়াদ,
যদিও এখন ওরা জানে
আমলা এবং নেতারা সবাই
লুটেরার মতো
বিত্ত-বেসাতির বখরা নিয়ে
জল খোঁজে – যোগ দেয় দলে –
ক্ষমতার এই
লড়াই কখনো ফুরাবে না;
তবু নাদু, রমিজ এবং
মালেকেরা ঘুরে-ঘুরে কোর্টে
যায়, কাচারিতে যায়, সাব-রেজেষ্ট্রি অফিসে গিয়ে ওরা
দাঁড়ায় এজলাসে –
স্বত্ব এবং আত্মবিক্রয়ের
দলিলে, সাবকাওলায়
সই ও টিপসই করে আসে –
হঠাৎ আবাক হই আরো:
দেখি তুমি তুলে নিচ্ছ কাপ
মুহূর্তে আমার মনে হলো
একটি ছিদ্রের মতো ভোর
আর শিশিরেরা ডানা মেলে
উড়ে আসছে
উঠে আসছে অফুরন্ত মাছি
মাছি … মাছি …
কুয়াশায় ঘাসের মাছির
উড়ন্ত প্রবাহ থেকে ছিঁড়ে
নিঃসঙ্গ উজ্জ্বল দুটি মাছি
বিমানের অবতরণের
মতো ঘুরে-ঘুরে উড়ে-উড়ে
পৃথিবীতে কোথাও একটি
নিরাপদ বিমানবন্দর
না পেয়ে নামল অবশেষে
আমাদেরই ভোরের টেবিলে।
দেখি: ডানার স্পন্দন রেখে
বসে আছে ফুরফুরে তারার
মতো দুটি তর্কাতীত মাছি –
একটি আমার কাপে আর
অন্যটি তোমার পিরিচের
কিনারে: হয়তো যাবে উড়ে
এখনই, খবরের কাগজের
পাতা উল্টানোর শব্দ শুনে
খসখসে হাওয়ায় –
ডানা মেলে – তর্কে বহুদূর।
ডালিমের নিজস্ব সংবাদ
ডালিম বিকীর্ণ হয়ে পড়ে আছে ঘরে
ডালিমের নিজের সংসারে।
বৃষ্টির ফোঁটা ও পাতাবাহার গাছ নিয়ে
বৃষ্টি ধরে এসেছে অনেকক্ষণ।
দোতলার ছাদ থেকে এখনো একটার পর একটা অনবরত বৃষ্টির ফোঁটা আমার বারান্দার টবের পাতাবাহর গাছের হলুদ আর লাল–সাদার ছিটপড়া একটা চৌকো ও চিরল পাতার ওপর ঝরে পড়ছে আল্লাহর আরশের মণিমুক্তোর মতো
অনেকক্ষণ ধরে আমি বসে বসে দেখছি এই শিথিল–স্বভাবের বৃষ্টির ফোঁটাগুলোর ঝরা আর আমার প্রিয় পাতাবাহার গাছের পাতার সেই ঝরন্ত বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে নীরবে গ্রহণ করার অনবরত কাঁপা দৃশ্যটি
আমার মনে হলো মানুষের জীবন এরকমই এক ধরণের অবর্ণনীয় আর অলৌকিক একটা অপ্রতিরোধ্য বিনিময়
আমার জীবনের ভিতরেও কোথায় যেন এমনি একটি উৎসুক পাতাবাহারের গাছ আছে যার অনেক পাতার ভিড়ের মধ্যে হলুদ আর লাল–সাদার প্রিণ্টআঁকা একান্ত ইন্দ্রিয়প্রবণ একটি পাতার ওপর কোনো এক অদৃশ্য কারনিস থেকে চুঁয়ে–চুঁয়ে বৃষ্টিফোঁটার মতো অনবরত তোমাকে চাওয়ার তোমাকে পাওয়ার তোমাকে হারাবার গতানুগত সেই দিনগুলোর অনেক চুম্বন আর অনেক গ্লানির অনেক আলিঙ্গন আর অনেক যৌনমিলনের শরীরী তীব্রতার আনন্দের ক্লান্তির আর অবসাদের স্মৃতির ফোঁটাগুলো ঝরে পড়েছে প্রচন্ড নিঃশব্দে – ভয়ংকর শ্লথতায় –
আর আমি আমার কবিতায় এই অবর্ণনীয় বিনিময়ের অভিজ্ঞতাগুলোই পুনর্বিন্যস্ত করতে চেয়েছি আজীবন।
মোরগ
আমি একটা উজ্জ্বল ঝলমলে ডানার সুন্দর মোরগ
ছাইগাদার ভিতর থেকে ঠুকরে–ঠুকরে তুলছি লাউয়ের ফুলের মতো টগবগে আগুন
আর খুঁটে–খুঁটে খাচ্ছি তোমার বাড়ির অপরাহ্নময় হৃদরোগ
কাটপ্রোজ বা চিলতে গদ্য সিরিজের কবিতা
১০
মুস্তফা আনোয়ার এখন রাজশাহীতে। উত্তরবঙ্গের কুয়াশায় বসে
বাংলা ব্যাকরণের বনবাদাড় আরেকবার ঘুরে-টুরে
দেখবেন বলে স্থির করেছেন-
এই সংবাদটুকু দিয়েই হো হো করে হেসে উঠলেন টেলিফোনে।
বললেন, ‘আবিদ, চলে আস, শীত পড়ার আগেই এসে পড়ো –
চমৎকার উষর ও মায়াবী ভঙ্গিতে তোমাকে
স্বাগতম জানাবে এই বরেন্দ্রভূমি
আমি আর মহীউদ্দিন পথে পথে প্রস্তুত করে রেখেছি
ধুলো, উলুঝুলু পাখি এবং ধোঁয়াটে কুয়াশা –
চলে আস।
যাওয়া যাবে দিনাজপুরের দিকে ছত্রখান দুপুরে
সাঁওতালদের পাড়ার খোঁজ নিতে না হয় চলে যাব সূর্যাস্তের দিকে
দেখব আখের ক্ষেতের পাশে পা ফাঁক করে মুততে বসেছে চিনিকলের ধোঁয়া
নওগাঁর দিকেও চলে যাওয়া যাবে ফিরোজের জিপে
ওখানে তোমার বন্ধু কামাল আছে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কামাল,
শুনেছি ওদিকে আরো বেশি ছেঁড়া ধুলো আরো বেশি কাবু জোৎস্না
এবং আরো আরো গভীরতর শীত–
চলে আস।’
শেষ হলো না কথা, ছিঁড়ে গেল এসটিডির লাইন
কিছুক্ষণ ঝুলে থাকলাম এদিকে টেলিফোনের রিসিভার কানে ধরে আমি
ওদিকে, উত্তরবঙ্গ, গোঁ গোঁ শব্দের মধ্যে ভাঙতে লাগল
আসন্ন শীতের আড়মোড়া
২৬
আমার পায়ে গামবুট
হাতে রবারের গ্লাভস্
চোখে লোহার গোল চশমা
মাথায় জংপড়া হ্যালমেট
কেরোসিন, পেট্রোল, কাদা
গ্রিজ এবং মবিলের পিচ্ছিল পথ পার হয়ে
ওয়েলডিং কারখানার ভিতরে
তোমার সুন্দর নগ্ন শরীর কোলে নিয়ে
আদর করতে–করতে
আমি লেদমেশিনের পাশে বসে–বসে কাঁদব
স্পষ্ট হচ্ছে
অস্পষ্ট হচ্ছে সামনের রাস্তা
মশার পিঠে চড়ে কুয়াশা নামছে
কাক ঠোকরাচ্ছে নিজের মরা ঠ্যাং
চড়ুই ঝরে পড়ছে ছাদে
টবের মাটি নষ্ট শিকড়ের পানি চাটার শব্দ শুনছে
কফ ঘন হয়ে উঠছে শীতে
কাজী পেয়ারার গাছের খসখসে পাতা গন্ধ শুঁকছে রুগ্ন ফুসফুসের
অস্পষ্ট হচ্ছে দূরের কাছের ফ্ল্যাটের জানালা বারান্দা ছাদ
স্পষ্ট হচ্ছে শুধু ফিরে যাওয়ার রাস্তা
চশমার কাচ মুছতে আর ভাল্লাগে না আমার।
0 Comments